বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৮ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হোক কিংবা অন্য কোন শত্রুতাবশত: হোক কিংবা নিজেদের অপরাধের কারণেই হোক মামলা-হামলা-গ্রেফতার আর তল্লাশির যে ভয়াবহ হয়রানি ও জুলুমের শিকার হতে হয়, তা প্রচলিত আইনের বিধি-বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
পুলিশ কোনো নাগরিকের গৃহ তল্লাশি করতে পারে দু’ভাবে। ১। আদালত হতে ইস্যুকৃত তল্লাশি পরোয়ানা বলে, ২। কোনো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে শুধু সেই মামলার আসামি গ্রেফতার বা মালামাল উদ্ধারকল্পে। এ বিষয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা-৯৬, ৯৮, ৯৯ক, ১০০, ৪৭ ও ১৬৫; অস্ত্র আইন-২৫; জুয়া আইন-৫ এ স্পষ্টভাবে বলা আছে। তবে গৃহ তল্লাশি শুরু করার আগেই ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৩ ধারা ও পিআরবি ২৮০ মোতাবেক পুলিশ কর্মকর্তা স্থানীয় দুই বা ততোধিক সম্মানিত ব্যক্তিকে সরেজমিন উপস্থিত থেকে তাতে সাক্ষী হওয়ার জন্য প্রয়োজনে লিখিতভাবে অনুরোধ করবেন। তল্লাশিকালে গৃহকর্তা অথবা তার মনোনীত কোনো প্রতিনিধিকে অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। তল্লাশিতে কাঙ্খিত কোনো মালামাল পাওয়া গেলে পুলিশ কর্মকর্তা তার একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। অতঃপর সেই তালিকায় উপস্থিত সাক্ষীদের স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন। এরপর সেই তালিকার একটি অনুলিপি চাহিদা মোতাবেক গৃহকর্তা বা তার প্রতিনিধিকে এবং সাক্ষীদের প্রদান করবেন। তল্লাশিকালে যদি কোনো মালামাল পাওয়া না যায়, তাহলে জব্দকৃত কোনো মালামাল নেই মর্মে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে উপরোল্লিখিত একই পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্টদের তার অনুলিপি প্রদান করতে হবে। শুধু তাই নয়, থানায় এসে পিআরবি’র ৩৭৭ বিধি অনুযায়ী জব্দ তালিকার বিষয়টি জিডিতে উল্লেখ করতে হবে। উক্ত জব্দকৃত মালামাল পিআরবি’র ৩৭৯ বিধি অনুযায়ী থানার সম্পত্তি রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
এখানে জেনে রাখি, জব্দ তালিকা বা সিজার লিস্ট হচ্ছে কোন মামলার সাথে সম্পৃক্ত এমন বস্তু বা আলামত, বেওয়ারিশ সম্পত্তি, চোরাইমাল, আগ্নেয়াস্ত্র এবং সন্দেহজনক কোন বস্তু বা জিনিস উদ্ধার করা। জব্দ তালিকা একটি মামলার প্রান। সাক্ষ্য আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী আদালতের ব্যাখ্যা বা উপস্থাপনামূলক হিসেবে জব্দ তালিকা প্রাসঙ্গিক বা গ্রহণযোগ্য। সাক্ষ্য আইন ৩৫ ধারা বলছে, সরকারি কর্মচারীর কর্তব্য সম্পাদনকালে সরকারি দলিল (বিপি নং ৪৪) লিপিবদ্ধ হিসেবে জব্দ তালিকা আদালতে গ্রহণযোগ্য। সাক্ষ্য আইন ৮০ ধারা বলছে, একটি বিশুদ্ধ দলিল হিসেবে গণ্য হবে জব্দ তালিকা।
এ প্রসঙ্গে মহামান্য হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ আছে ৪৫ ডিএলআর ২৯৭ পৃষ্ঠায়। এ মামলায় হাইকোর্ট বলেছেন, সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তল্লাশি চালানোর বিধান করার লক্ষ্য হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভাব্য চাতুরী ও মনগড়া কিছু করার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ তৈরি করা। তল্লাশি যে সততার সঙ্গে হয়েছে তা নিশ্চিত করা তার জন্য বাধ্যতামূলক।
ভুক্তভোগীরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেরাই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক পদার্থ বা মাদকদ্রব্য তাদের দখলে রেখে অতঃপর সেই দখল রাখার অপরাধ দেখিয়ে তাদের ফাঁসিয়ে দেয়। এমন অভিযোগের সত্য-মিথ্যা তদন্তসাপেক্ষ হলেও বাস্তবতার সাথে মিল রয়েছে।
সেকারণেই পুলিশ বিভাগের বাইবেল বলে খ্যাত পি আর বি’র ২৮০ রেগুলেশন এর বিধান অনুসারে কোনো স্থান তল্লাশি করার জন্য প্রবেশের পূর্বে অবশ্যই পুলিশ অফিসার নিজের কাছে কিছু নেই তা উপস্থিত সাক্ষী কর্তৃক প্রবেশের পূর্বেই সার্চ করাতে হবে। নতুবা নিজেদের বহন করা মালামাল দিয়ে যে কাউকে ফাসিয়ে দিতে পারেন।
এখানে সম্মানিত ব্যক্তি বলতে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বোঝাবে, যিনি নিরপেক্ষ হবেন এবং যাকে তল্লাশি স্থানের মালিক বা প্রতিনিধি বিশ্বাস করতে পারেন। এ ধারার বিধানগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ ব্যতিরেকে কোনো গৃহ তল্লাশি করা বা কোনো সন্দেহভাজন মালামাল জব্দ করা অবৈধ বা বেআইনি কর্ম বলে গণ্য হবে বলে উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট কোনো জিনিস বিশেষ কোনো ব্যক্তির দখলে আছে বলে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গতভাবে যদি জানা যায়, তবেই সেই ক্ষেত্রে কেবল বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো যেতে পারে। অন্যথায় তল্লাশি পরোয়ানা ব্যতীত তল্লাশি বেআইনি। তল্লাশিকালে প্রাপ্ত মালামাল তালিকাসহ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৫ ধারানুযায়ী যথাশিগগির সম্ভব তল্লাশিকারী পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করবেন। উল্লেখ্য, কোনো গৃহের দখলদার দাগি, দুশ্চরিত্র কিংবা ফেরারি আসামি আছে, শুধু এই অজুহাতেই সেই গৃহ বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো যাবে না।
পুলিশ বিভাগের বাইবেল বলে খ্যাত পিআরবি’র ২৮০ তে তল্লাশি শুরুর আগেই উপস্থিত সাক্ষী, গৃহকর্তা/প্রতিনিধির সামনে তল্লাশিকারী প্রত্যেক পুলিশ কর্মকর্তা, তাদের সহকারী, সংবাদদাতা (যদি থাকে) প্রমুখের নিজ নিজ দেহ পরীক্ষা করে নিতে হবে। এমন সৌজন্যতার সঙ্গে তল্লাশির ব্যবস্থা করতে হবে, যেন গৃহবাসী, বিশেষ করে মহিলাদের তাতে যথাসম্ভব কম অসুবিধা ঘটে। সাক্ষীরা যাতে সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষ বা পুলিশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হন, সে বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদি সম্ভব হয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সদস্য বা এলাকার প্রধান ব্যক্তিকেও তল্লাশি কর্মকা- দেখার জন্য উপস্থিত রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই কোনো সোর্স বা গুপ্তচর, অভ্যস্ত মদ্যপ বা সন্দেহভাজন চরিত্রের লোককে তল্লাশি সাক্ষী হিসেবে তলব করা যাবে না।
যখন বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য কোনো গৃহ তল্লাশি চালানোর প্রয়োজন হবে, তখন অস্ত্র আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অবশ্যই পরোয়ানা সংগ্রহ করতে হবে। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য কোনো পুলিশ অফিসার নিজ উদ্যোগে গৃহ তল্লাশি করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। তল্লাশিকারী কর্মকর্তা এমনভাবে তল্লাশি চালাবেন, যেন উপস্থিত সাক্ষীদের মনে এরূপ সন্দেহ করার কোনো অবকাশই না থাকে যে, তল্লাশিকারী পুলিশ কর্মকর্তা বা তাদের সঙ্গীরা গৃহকর্তাকে ফাঁসানোর জন্য কোনো জিনিস আগে থেকেই গোপনে ঘরে রেখে দিয়েছে। মোটামুটি এই হল গৃহ তল্লাশি সম্পর্কিত আইনের বিধানাবলী। মহামান্য হাইকোর্ট বলছেন, যা ৬০ ডিএলআর ৩৪ পাতায় উল্লেখ রয়েছে যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৩ ধারার বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন না করে অপরাধমূলক দ্রব্যাদি তল্লাশি করা এবং জব্দ করা বৈধ হতে পারে না।
সুতরাং সংশ্লিষ্ট কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি এই বিধানের ব্যত্যয় করেন, তবে তা আইনবহির্ভূত বা বেআইনি কাজ বলে গণ্য হবে। সেই বেআইনি কাজটির জন্য তার দু’ধরনের শাস্তি হতে পারে, ১। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে, শুধু গাফিলতির কারণে যদি বিধানের ব্যত্যয় হয়; তবে তাতে তার হতে পারে প্রশাসনিক শাস্তি। যেমন- পদাবনতি, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি, ২। তা যদি হয় এমন কাজ- অপরাধ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ইত্যাদি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য হবে অন্য সব সাধারণ অপরাধীর মতোই। তবে অনেকের অভিমত হচ্ছে- অন্যদের চেয়ে পুলিশের শাস্তির মাত্রা বরং বেশি হওয়া উচিত। কেননা তাদের দায়িত্বই হল অপরাধ নিবারণ আর এজন্য রাষ্ট্র ও আইন তাদের দিয়েছে বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদা। সুতরাং ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে অসহায় নাগরিকদের জীবনকে বিপন্ন করার দায় পুলিশের জন্য তুলনামূলকভাবে অন্য অপরাধীদের চেয়ে অনেক বেশি। পৃথিবীর অনেক সভ্য দেশের আইনে এ ধরনের নজিরও আছে এবং এমন বেআইনি কর্মের জন্য তাদের সম্ভাব্য যেসব শাস্তি হতে পারে, তার উল্লেখ আছে দ-বিধিতে। যেমন দন্ডবিধির ১৬৬, ৪২৭, ৩৯২/৩৯৫ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইন এর ধারা ১০-এ। ক্ষেত্রভেদে এসব শাস্তির পরিমাণ হতে পারে ২ থেকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ-। কোনো নাগরিক যদি এসব অপরাধ-অনাচার হতে কোনো বৈধ বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে কোনো আশ্রয় না পান, তাহলে এমন বেআইনি ও অপরাধমূলক অপতৎপরতা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে দ-বিধি-১০৪ ধারা মোতাবেক আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। যে ধারায় বলা হয়েছে- সম্পত্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত বা প্রচেষ্টারত অপরাধ যদি সাধারণ চুরি, ক্ষতি বা গৃহে অনধিকার প্রবেশ সম্পর্কিত হয়; সে ক্ষেত্রে সম্পত্তি সংক্রান্ত আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে অপরাধকারীর মৃত্যু ঘটানো ব্যতিরেকে যে কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করা যাবে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮